তিন্দুক, পেচক ও মূষিকের কথকতা
লেখক : মোঃ ওসমান গনি, Laboni Building, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, গবেষণা বিভাগ, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টটিউিট, বাংলাদেশ
ভূমিকা
তিন্দুক শব্দের অর্থ ঘনছায়া, গাব গাছের সংস্কৃত নাম। কৃষ্ণবর্ণের ছালদ্বারা আবৃত শাখা-পশাখা গাঢ় সবুজ পল্লবে ভরপুর চিরসবুজ বহুবর্ষজীবী গাবগাছ একটি অপ্রধান ফল হিসেবে বাংলাদেশে সর্বত্র দেখা যেত। দূর থেকে দেখলে গাছটিকে মনে হয় ফুটানো একটি বড় ছাতা, যেন “অনেক পাতার ঘনিষ্টতায় একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।
গাবগাছ “এমবেনেসি” পরিবারভুক্ত, বৈজ্ঞানিক নাম “ডায়সপইরস পিরিগরিনা, “তমাল ও পুষ্পিত নাগেশ্বর একই জেনাসভুক্ত। গাছের ফল সবুজ অবস্থায় চ‚র্ণ করে আসবাবপ্রত, মাছ ধরার জাল প্রভৃতি রঙ করার কাজে ব্যবহৃত হয়। হলুদবর্ণের পাকা ফলের ভিতরের ৬-৮টি আঠালো বীজ মিষ্টি ও সুস্বাদু। কাঠ ধূসর বর্ণের, অত্যন্ত ভারী, তাই ঢেঁকি তৈরির একমাত্র উপাদান। গাছের ছাল, ফল ও বীজ বিভিন্ন রোগের ওষুধরূপে ব্যবহৃত হয়। এর আছে উপযোগিতা ও ভেষজ গুণ। তবু গাবগাছে “ভ‚তের বাসা” এই কুসংস্কারের কারণ এর ঘন পাতার ছায়া যেখানে দিনের বেলায়ও দৃষ্টি পৌছায় না। তাই দিনের বেলায় এর অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে পেঁচা ও অন্যান্য নিশাচর উপকারী পাখি। শ্যাওড়া গাছের ঝোপও প্রায় একই প্রকৃতির। ভ‚তের ভয়ে, পেটের দায়ে আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে আমরা দিনের আলোর নির্বিচারে গাব, শ্যাওড়াসহ অন্যান্য গাছ কেটে বিভিন্ন প্রজাতির পক্ষিকুল, বিশেষ করে ইঁদুর খেকো অতি উপকারী পেঁচাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি, আর এভাবে প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন করে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছি।
লাজুক প্রকৃতির নিশাচর পাখি পেঁচা, পেচক নামেও পরিচিত, দিনের বেলায় বড় গাছের ছায়াঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এর পরও অচ্ছুত আর দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। তার কারণ রাতে এদের বিকট শব্দে বিশ্রীস্বরের ডাক, আর বড় গোলাকৃতি মাথা, তারার মত উজ্জল বিস্ফোরিত চোখ, যা না থাকলে সে রাতে দেখতেই পেত না। পেঁচা স্ট্রাইগাফরমিল গোত্রের পাখি। বাংলাদেশে এদের দুটো প্রজাপতিই সংখ্যায় বেশি। একটি বানরমুখো ছোট আকৃতির চিত্রিত পেঁচা, অন্যটি বড় আকারের, মাথায় খাড়া পালক ও পায়ে পালক বিশিষ্ট গ্রেট হর্ন পেঁচা। ঘনছায়ায় ঢাকা গাবগাছ এদের প্রিয় আবাস ও প্রজনন ক্ষেত্র। প্রয়োজনে শ্যাওড়া, তেতুঁল বা অন্য বড় গাছেও আশ্রয় নেয়। স্বাভাবে লাজুক হলেও ক্ষুধার তাড়নায় সন্ধায় এরা চাঙ্গা হয়ে উঠে আর তখনই তীক্ষè শব্দে সঙ্গীদের ডেকে নিঃশব্দে উড়ে যায় বসতবাড়ির আঙ্গিনায় আর ফসলের মাঠে। নিশ্চিত নিশানা আর তীক্ষè নখর দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে কাবু করে ফেলে নিশাচর ধূর্ত ইদুঁরকে। প্রতিটি পেঁচা বছরে এক হাজারের অধিক ইদুঁর খায়, যেমন প্রতিটি ব্যাঙ প্রায় পাঁচ লক্ষ পোকা খায়। অন্যদিকে এক হাজার ইদুঁর বছরে লক্ষাধিক টাকার সম্পদ উজাড় করে। খাবারের অভাবে ফড়িং, ছোট পাখি অন্য সরীসৃপ ধরার জন্য গোধূলীলগ্নে বৈদ্যুতিক খুুঁটি বা অন্যত্র কদাচিত দেখা যায় পেচক-পেচকীদের।
“উই ইদুঁর কুজন-সর্বনাশা এই তিনজন” প্রবাদেই ইদুঁরের ক্ষতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ইদুঁরকে তুচ্ছার্থে মূষিক বলা হয়। মাঠের পাকা ফসল, গোলার শস্য, বীজ, রান্না করা খাবার, শীতের লেপ এমনটি বিদ্যুতের তার কোন কিছুই এদের আক্রমণ থেকে রেহাই পায় না। এছাড়া স্তন্যপায়ী গোত্রের প্রাণী হওয়ায় মানুষের মধ্যে নানা সংক্রামক রোগ ছড়ায়। মানুষের ক্ষতি করার সাথে সাথে বংশবৃদ্ধিতে এদের জুড়ি নেই। প্রতিবার ১০-১২টি বাচ্ছা দিয়ে থাকে। বছর শেষে একজোড়া ইদুঁরের বংশধরের সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজার। বাংলাদেশে ১০-১২ প্রজাতির ইদুঁর দেখা যায়। উচুঁ রাস্তা, বাঁধের ঢালে, উচুঁ জমির আইলের গর্তে, গুদাম ও ঘরে এরা বসবাস করে। বসতি এলাকায় খাদ্যের অভাব হলে ফসলের মাঠে ছড়িয়ে পড়ে ফসল খায় এবং গর্তে নিয়ে জমা করে। ইদুঁর মাঠের ফসরের প্রায় দশভাগ নষ্ট করে এবং বছরে গুদামের শস্য ৪০-৫০ কেজি একাই সাবাড় করে।
বর্তমানে ইদুঁর দমনের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক প্রদার্থ ব্যবহার হচ্ছে যার কুফল হিসেবে অন্যান্য উপকারী প্রাণী ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া একবার বিষ খেখে ঐ স্থানে প্রায় তিনমাসের মধ্যে দ্বিতীয় বার খাবার সম্ভাবনা কম। এসব বিবেচনায় রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইদুঁর দমনের পাশাপাশি ফাঁদ দিয়ে, গর্তে পানি বা ধোঁয়া দিয়ে, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে, জমির আইল সরু করে, আঠা ফাঁদ দিয়ে ও অন্যান্য উপায়ে ইদুঁর দমনের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। এছাড়া প্রকৃতিতে ইদুঁর খেকো প্রাণী (বিড়াল) পালন করে, বন্য প্রাণী যেমন পেঁচা, ঈগলপাখি, বেজী, সোনাগুই, গুই এর আবাসন ও প্রজনন সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের বংশ বৃদ্ধি করে ইদুঁরের ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
প্রাকৃতিক খাদ্য চক্রে পোকা ফসল খায়, ব্যাঙ পোকা খায়, সাপ ব্যাঙ খায়, বেজী-ঈগলপাখি সাপ খায়। একই ভাবে ইদুঁর ফসল খায়, পেঁচা ইদুঁর খায়। এজন্য পেচককুল কৃষকের খবই উপকারী বন্ধু। প্রতিটি বসবাড়িরে পিছনে অন্তত একটি উচু বড় মাঠে দু’তিনটি এবং পতিত জায়গায় গাবগাছ লাগিয়ে আর্থিক লাভের পাশাপাশি পেঁচার আবাস নিরাপদ ও নিশ্চত করে নিকটস্থ মাঠ ও বসতবাড়ির ইদুঁর প্রাকৃতিক উপায়ে দমনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন এবং জানুন Please click here
আরও পড়ুন এবং জানুন Please click here
লেখক : মোঃ ওসমান গনি, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, গবেষণা বিভাগ, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টটিউিট, বাংলাদেশ